https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

মাটির সুর, প্রাণের গান: বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাস, বাদ্যযন্ত্র এবং ঘরানা

top-news
  • 05 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

নদীর স্রোতে ভেসে আসা সুর

বাংলাদেশের মানচিত্রটা যদি খেয়াল করেন, দেখবেন পুরো দেশটা যেন অসংখ্য নদ-নদী দিয়ে বোনা একটা জাল। আর এই নদীর স্রোতের মতোই এদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে গান। আমাদের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে, আর দিন শেষ হয় কোনো এক উদাস বাউলের একতারার সুরে। বাংলা লোকসংগীত বা 'ফোক মিউজিক' আসলে কোনো স্টুডিওতে তৈরি হওয়া গান নয়; এ হলো এদেশের মাটি ও মানুষের হৃদস্পন্দন। কৃষকের লাঙল চষার রিদম, মাঝির দাঁড় টানার ছপছপ শব্দ, কিংবা তপ্ত দুপুরে উদাস পথিকের ক্লান্তি—সবই যেন সুর হয়ে বেরিয়ে আসে।

আজকের এই যান্ত্রিক জীবনে আমরা হয়তো স্পটিফাই বা ইউটিউবে ফিউশন শুনছি, কিন্তু আমাদের আসল পরিচয় লুকিয়ে আছে সেই মাটির গানে। হাজার বছর ধরে এদেশের গ্রামীণ মানুষ তাদের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ এবং সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করে আসছে এই গানের মাধ্যমে। আজ আমরা সেই শেকড়ের সন্ধানে বের হবো। জানবো আমাদের লোকসংগীতের ইতিহাস, এর বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্র এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন সুরের কথা।

১. ইতিহাসের পাতা ও লোকসংগীতের বিবর্তন

বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে চর্যাপদের যুগে। তবে লোকগানের যে রূপ আমরা আজ দেখি, তার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগে। এই গান কোনো রাজদরবারের উচ্চাঙ্গসংগীত নয়, বরং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।

  • ধর্ম ও দর্শনের মিলন: বাংলা ফোক মিউজিকের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এখানে হিন্দু বৈষ্ণব পদাবলি আর সুফিবাদের এক অদ্ভুত মিলন ঘটেছে। একদিকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি নিবেদন—সব মিলেমিশে একাকার।

  • মরমি সাধক: লালন সাঁই, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, আর শাহ আব্দুল করিমের মতো মহাজনরা এই গানকে শুধু বিনোদন নয়, বরং একটি দর্শনে রূপান্তর করেছেন। লালন যখন বলেন, "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি", তখন তিনি আসলে দেহ ও আত্মার সম্পর্কের কথা বলেন। এই 'দেহতত্ত্ব' হলো বাংলা লোকগানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।

২. অঞ্চলভেদে গানের বৈচিত্র্য (ঘরানা ও শৈলী)

বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু এর মাটির গন্ধে ভিন্নতা আছে। আর মাটির ভিন্নতার সাথে সাথে বদলে গেছে গানের সুর। নদীমাতৃক ভাটি অঞ্চল, উত্তরবঙ্গের রুক্ষ মাটি কিংবা পাহাড়ি জনপদ—প্রতিটি জায়গার নিজস্ব 'সাউন্ডস্কেপ' আছে।

  • বাউল গান (আত্মার খোরাক): বাউল গানকে ইউনেস্কো 'মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কুষ্টিয়া, যশোর এবং বৃহত্তর নদীয়া অঞ্চল হলো বাউল গানের চারণভূমি। বাউলরা ঘরকুনো নন, তারা পথে পথে ঘোরেন। তাদের গানে সংসার ত্যাগ, সৃষ্টিকর্তার সন্ধান এবং মানুষের জয়গান থাকে। একতারা আর ডুগডুগি বাজিয়ে যখন তারা গান ধরেন, তখন মনে হয় জাগতিক সব কষ্ট তুচ্ছ।

  • ভাটিয়ালি (নদীর গান): ভাটিয়ালি হলো মাঝিদের গান। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল অর্থাৎ ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং সিলেটের হাওর এলাকার গান এটি। নদীতে যখন পাল তোলা নৌকা ভাসে, মাঝির হাতে তেমন কাজ থাকে না। তখন বিশাল নদীর শূন্যতা আর প্রকৃতির বিশালতার সাথে পাল্লা দিয়ে মাঝি গলা ছেড়ে গান ধরেন। ভাটিয়ালি গানে 'টান' বা দীর্ঘ স্বর থাকে, যা নদীর স্রোতের মতোই প্রলম্বিত।

  • ভাওয়াইয়া (উত্তরের দীর্ঘশ্বাস): রংপুর, দিনাজপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের গান হলো ভাওয়াইয়া। এই অঞ্চলটি কিছুটা উঁচু ও রুক্ষ। এখানকার মানুষ গরুর গাড়ি চালায়। গরুর গাড়ির চাকা যখন এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলে, তখন যাত্রীর গলার স্বর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এই কাঁপা স্বর বা 'ভাজ' হলো ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্য। এই গানে প্রেম এবং বিরহ খুব করুণভাবে ফুটে ওঠে। আব্বাসউদ্দীন আহমদ এই গানকে শহরের ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

  • গম্ভীরা (রঙ্গরসে সমাজ সচেতনতা): চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা এক অনন্য লোকনাট্য ও গান। এখানে 'নাতি' এবং 'নানা'র চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি, দুর্নীতি বা সমস্যা তুলে ধরা হয়। এটি মূলত শিবপূজার অংশ ছিল, যা পরে সামাজিক গানে রূপ নেয়। এর তালে তালে যে নাচ হয়, তা দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।

  • জারি ও সারি গান: জারি গান সাধারণত শোকের গান, যা মহরমের সময় গাওয়া হয়। আর সারি গান হলো কর্মসংগীত। বিশেষ করে নৌকা বাইচের সময় মাঝিদের উৎসাহ দিতে সারি গান গাওয়া হয়। "হেইয়্যারে হেইয়্যা" ধ্বনির সাথে যে রিদম তৈরি হয়, তা শরীরে অদ্ভুত এক শক্তি যোগায়।

৩. বাদ্যযন্ত্র: প্রকৃতির উপাদান যখন কথা বলে

বাংলা লোকসংগীতের বাদ্যযন্ত্রগুলো আধুনিক গিটার বা ড্রামসের মতো কারখানায় তৈরি হয় না। এগুলো তৈরি হয় লাউয়ের খোল, কাঠ, চামড়া আর বাঁশ দিয়ে। অর্থাৎ, বাদ্যযন্ত্রগুলোও প্রকৃতিরই সন্তান।

  • একতারা: বাউল গানের প্রতীক। লাউয়ের খোলের সাথে একটিমাত্র তার। এই একটি তারেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সুর তোলা হয়। এটি মূলত তাল বা ড্রোন ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

  • দোতারা: লোকগানের মূল মেলোডি বা সুর তোলে দোতারা। নাম দোতারা হলেও এতে চারটি বা তার বেশি তার থাকে। কাঁঠাল বা নিম কাঠ দিয়ে তৈরি এই যন্ত্রের টুংটাং শব্দ মনকে এক নিমেষে গ্রামে নিয়ে যায়।

  • বাঁশি: বাঁশের বাঁশি ছাড়া বাংলা গান অসম্পূর্ণ। ভাটিয়ালি গানে বাঁশিতে যে করুণ সুর তোলা হয়, তা শুনলে মনে হয় বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে।

  • ঢোল ও খোল: গানের রিদম বা তাল ধরে রাখার জন্য ঢোল অপরিহার্য। বিশেষ করে জারি, সারি বা কবিগানে ঢোলের গুরুগম্ভীর শব্দ রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আর কীর্তন বা বৈষ্ণব গানে ব্যবহৃত হয় খোল বা মৃদঙ্গ।

  • মন্দিরা: ছোট দুটি কাঁসার বাটি। একে অপরের সাথে ঠুকে যে ঝনঝন শব্দ হয়, তা গানের লয় ঠিক রাখতে সাহায্য করে।

৪. আধুনিকতা ও ফিউশন: সংকট নাকি সম্ভাবনা?

আজকের যুগে কোক স্টুডিও বাংলা (Coke Studio Bangla) বা আর্নবের মতো শিল্পীরা লোকগানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছেন। 'সর্বত মঙ্গল রাধে' বা 'নাসেক নাসেক' এখন তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে। অনেকে বলেন, এতে গানের আসল ভাব নষ্ট হচ্ছে। আবার অনেকের মতে, এই ফিউশনের মাধ্যমেই নতুন প্রজন্ম তাদের শেকড়কে চিনছে।

সত্যি বলতে, লোকসংগীত কোনো স্থির পুকুর নয়, এটি বহমান নদী। শাহ আব্দুল করিম নিজেও তার সময়ে গানে নতুনত্ব এনেছিলেন। তাই ইলেকট্রিক গিটার বা ড্রামসের সাথে দোতারার যুগলবন্দী যদি গানের আত্মাকে আঘাত না করে, তবে তাকে স্বাগত জানানোই উচিত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আধুনিকতার চাকচিক্যে যেন গানের 'বাণী' বা কথা তার গভীরতা না হারায়।

৫. আমাদের করণীয় ও ভবিষ্যৎ

আমাদের লোকসংগীত আমাদের জাতীয় পরিচয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক গ্রামীণ শিল্পী আজ অর্থাভাবে গান ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেক প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র বিলুপ্তির পথে। আমাদের শুধু ইউটিউবে গান শুনলেই হবে না, এই শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে 'ফোক ফেস্ট'-এর মতো আয়োজন আরও বাড়াতে হবে, তবে তা যেন শুধু শহুরে বিনোদন না হয়ে গ্রামানুখী হয়।

উপসংহার

বাংলা লোকসংগীত শুধু কিছু সুরের সমষ্টি নয়। এটি একটি জীবনব্যবস্থা, একটি দর্শন। বাউলের একতারায় যে মুক্তির ডাক আছে, ভাটিয়ালি গানে যে প্রকৃতির বিশালতা আছে—তা পৃথিবীর আর কোনো গানে পাওয়া ভার। প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাক, আমাদের মন খারাপের দিনে কিংবা অকারণ আনন্দের মুহূর্তে আমরা বারবার ফিরে যাবো এই মাটির গানের কাছেই। কারণ, এই গান আমাদের অস্তিত্বের কথা বলে, আমাদের আত্মার কথা বলে। আসুন, আমাদের এই অমূল্য সম্পদকে বুকে ধারণ করি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিই।

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *